রমজান অন্য সব মাসের মতো সাধারণ মাস নয় কেনো ??
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মাহে রমজানকে বহু ফজিলত ও মর্যাদা দিয়ে মহিমান্বিত করেছেন। এ মাসের মর্যাদা সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন- যখন রমজান মাস আসে তখন জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। আর শয়তানকে শৃঙ্খলিত করে রাখা হয়। (সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিম)।
এ মাসের ফজিলত সম্পর্কে মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও ইরশাদ করেন- তোমাদের নিকট রমজান মাস এসেছে। এ মাসটি বরকতময়। আল্লাহ তাআলা তোমাদের উপর এ মাসের রোজা ফরজ করেছেন। এ মাসে আসমানের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। আর শয়তানকে শৃঙ্খলিত করে রাখা হয়।
এ মাসে এমন একটি রাত আছে যা এক হাজার রাতের চেয়েও উত্তম। যে ব্যক্তি সেই রাতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত সে সকল কল্যাণ থেকেই বঞ্চিত। (সুনানে নাসায়ি)।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেছেন- এ মাসে একজন আহবানকারী আহবান করতে থাকে, হে ভালোর অন্বেষণকারী! তুমি অগ্রসর হও। হে মন্দের অন্বেষণকারী! তুমি থেমে যাও। কেননা আল্লাহ তাআলা এ মাসে বহু লোককে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন। আর এ ঘোষণা রমজান মাসের প্রতি রাতেই হয়ে থাকে।” (জামে তিরমিজি ও সুনানে ইবনে মাজাহ)।
এসব বাণীসমূহ থেকে স্পষ্ট বুঝা যায়, রমজান মাস অন্য সব মাসের মতো সাধারণ কোনো মাস নয়। এটি অত্যন্ত পবিত্র ও পূণ্য অর্জনের মাস।
মর্যাদাপূর্ণ মাস। এর কারণ হলো এ মাসে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মানবজাতির হিদায়াতের জন্য পবিত্র কুরআন নাজিল করেন। মূলত কুরআন মাজিদকে বুকে ধারণ করার কারণেই এ মাস এতো বরকতময় এবং এ মাসের এতো মর্যাদা, এতো গুরুত্ব।
কারণ কুরআন মাজিদ হলো পরশ পাথরের ন্যায়, যে’ই তার সংস্পর্শ পায় সে’ই বরকতময় হয়ে উঠে। তাছাড়া কুরআন মাজিদ মানুষের জন্য আল্লাহ তাআলার দেয়া নিয়ামতসমূহের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ নিয়ামত। এর নাজিলের ঘটনা মানবতার ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করেন- রমজান হলো সে মাস, যে মাসে কুরআন নাজিল করা হয়েছে, যা মানব জাতির জন্য হিদায়াত এবং সত্য পথ যাত্রীদের জন্য সুস্পষ্ট পথ-নির্দেশ আর ন্যায়-অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য বিধানকারী। কাজেই তোমাদের মধ্যে যেই এ মাসটি পাবে, সে যেন এ মাসের রোজা রাখে।” (সূরা আল বাকারাহ, আয়াত নং-১৮৫)।
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মানবজাতিকে সৃষ্টি করেই তাঁর দায়িত্ব সমাপ্ত করেননি, বরং তিনি সৃষ্টির সাথে সাথে তাদেরকে সত্য পথ প্রদর্শনের জন্য যুগে যুগে অসংখ্য নবি ও রাসূল প্রেরণ করেছেন এবং তাঁদের মাধ্যমে তিনি তাঁর দিক নির্দেশনা পাঠিয়েছেন।
মহাগ্রন্থ কুরআন মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে মানব জাতির জন্য সর্বশেষ দিক নির্দেশনা বা হিদায়াত। আর এ কুরআন মাজিদ রমজান মাসে নাজিল হয়েছে। অন্য সকল আসমানি কিতাবও এ পবিত্র মাসে নাজিল হয়েছে।
এ মাসেরই ৬ তারিখে হজরত মুসা আলাইহিস সালামের উপর তাওরাত, ১৮ তারিখে হজরত দাউদ আলাইহিস সালামের উপর যাবুর, ১৩ তারিখে হজরত ইসা আলাইহিস সালামের উপর ইনজিল এবং এ মাসের শেষ ১০ দিনের কোনো এক বিজোড় রাতে লাওহে মাহফুজ থেকে পৃথিবীতে হেরা গুহায় পবিত্র কুরআন মাজিদ নাজিলের সূচনা হয়।
এরপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ২৩ বছরের নবুয়তি জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রয়োজন অনুসারে অল্প অল্প করে সমগ্র কুরআন নাজিল সম্পন্ন হয়।
কুরআন মাজিদ নাজিলের সূচনার এ রাতকে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ‘লাইলাতুল কদর’ নামে অভিহিত করেছেন। তিনি ইরশাদ করেন- নিশ্চয় আমি একে (কুরআন মাজিদ) নাজিল করেছি লাইলাতুল কদরে। (হে রাসূল), আপনি কি জানেন লাইলাতুল কদর কী? লাইলাতুল কদর হলো এক হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। এতে প্রত্যেক কাজের জন্যে ফেরেশতাগণ ও রূহ নাজিল হয় তাদের রবের নির্দেশক্রমে। বিরাজ করে শান্তি, যতক্ষণ না ঊষার আবির্ভাব হয়।” (সূরা আল কদর, আয়াত নং- ১-৫)
পবিত্র কুরআন মাজিদের মর্ম অনুধাবনের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতেই মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এ মাসে জান্নাতের দরজাগুলো উন্মুক্ত করে দেন, জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেন এবং শয়তানকে শৃঙ্খলিত করে রাখেন।
যাতে মানুষ জান্নাতি পরিবেশে শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে মুক্ত হয়ে পবিত্র কুরআন মাজিদের মর্ম উপলব্ধি করতে পারে। মূলত মাহে রমজানের হক হলো মানুষ কুরআন নিয়ে গবেষণা করবে এবং উপলব্ধি করে কুরআন ও সুন্নাহ ভিত্তিক জীবন গঠন করার চেষ্টা করবে।
এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করেন- এটি একটি বরকতময় কিতাব, যা আমি আপনার প্রতি অবতীর্ণ করেছি, যাতে মানুষ এর আয়াতসমূহ অনুধাবন করে এবং বোধশক্তি সম্পন্ন ব্যক্তিগণ উপদেশ গ্রহণ করে। (সূরা ছোয়াদ, আয়াত নং- ২৯)।
রমজান হলো রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস। রমজান তখনই মানুষের জন্য পূর্ণাঙ্গ রহমত, মাগফিরাত ও নাজাত বয়ে আনবে যখন মানুষ কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী আমল করবে। কেননা কুরআন মাজিদ নাজিলের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যই হলো- মানুষকে দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণের পথে পরিচালনা করা।
এ সম্পর্কে সাহাবি হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন- রমজান মাসের প্রতি রাতে জিবরাইল আলাইহিস সালাম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট হাজির হতেন এবং তাঁরা উভয়ই কুরআন মাজিদ তিলাওয়াত করে একে অপরকে শোনাতেন।” (সহিহ বুখারি)।
কুরআন তিলাওয়াত করাকে মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বোত্তম নফল ইবাদত বলে অভিহিত করেছেন। ইরশাদ হয়েছে- কেউ যদি আল্লাহর কিতাবের একটি হরফ পাঠ করে, তাহলে সে নেকি পায়। আর এ নেকির পরিমাণ হলো দশগুণ। (তিরমিজি শরিফ)। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো ইরশাদ করেন- আমার উম্মতের সর্বোত্তম ইবাদত (নফল) হলো কুরআন তিলাওয়াত। (বায়হাকি)।
মাহে রমজানের সঙ্গে পবিত্র কুরআন মাজিদের বিশেষ সম্পর্ক বিদ্যমান। হাদিস থেকে জানা যায়, এ সম্পর্ক দুভাবে হয়। প্রথমত রমজান মাসে রাতদিন কুরআন তিলাওয়াত করা এবং দ্বিতীয়ত রাতে তারাবিহের সালাতে কুরআন তিলাওয়াত করা বা শোনা। সারা বছরই কুরআন তিলাওয়াত করতে হবে।
তবে রমজান মাসে কুরআন তিলাওয়াতে অতিরিক্ত সাওয়াব ও বরকত রয়েছে। এ কারণে সাহাবায়ে কিরাম, বুজর্গানে দীন ও আধ্যাত্মিক সাধকেরা রমজান মাসে কুরআনময় হয়ে যেতেন। কুরআন মাজিদের সাথে গড়ে তুলতেন বিশেষ সম্পর্ক।
রমজান মাসে সাহাবায়ে কিরাম কুরআন মাজিদ মুখস্থ করার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করতেন। উম্মুল মুমিনীন হজরত আয়িশা (রা.) রমজান মাসে সুবহে সাদিকের পর থেকে সুর্যোদয় পর্যন্ত পবিত্র কুরআন মাজিদ তিলাওয়াত করতেন।


No comments:
Post a Comment